পুরান ঢাকার বাকরখানি – ইতিহাস, স্বাদ ও প্রস্তুত প্রণালী

tek news icon bd

TEK NEWS DESK

August 13, 2025

বাকরখানি: ঢাকার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি রুটি

বাংলাদেশের খাদ্য সংস্কৃতির ইতিহাসে কিছু খাবারের স্থান একেবারেই অনন্য। ঢাকার পুরান শহরের গলি থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা চায়ের দোকান ও বেকারিতে এক বিশেষ নাম বারবার শোনা যায়—বাকরখানি। এটি শুধু একটি খাবার নয়, বরং একটি ইতিহাস, একধরনের ঐতিহ্য এবং ঢাকার পুরনো দিনের স্মৃতির বাহক।

বাকরখানির পরিচিতি

বাকরখানি মূলত এক ধরনের শক্ত, মিষ্টি, সুগন্ধি রুটি। বাইরে খাস্তা আর ভেতরে খানিকটা নরম, মিষ্টি স্বাদের এই রুটি সাধারণত চা বা দুধ চায়ের সাথে খাওয়া হয়। বিশেষত সকালে নাস্তা বা বিকেলের আড্ডায় এর জনপ্রিয়তা অপরিসীম। পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের কাছে এটি যেন দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে গেছে।

এর আকার সাধারণত গোল এবং চ্যাপ্টা, পুরুত্ব মাঝারি। উপরের অংশে নকশা করা থাকে, যা শুধু সৌন্দর্যই বাড়ায় না, বরং খাস্তা হওয়ার ক্ষেত্রেও সাহায্য করে।

উৎপত্তি ও ইতিহাস

বাকরখানির ইতিহাস ঢাকার মোগল আমলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইতিহাসবিদদের মতে, বাকরখানি এসেছে কাশ্মীর থেকে, পরে লখনউ হয়ে ঢাকায়। আর ঢাকায় আসার পর এটি হয়ে ওঠে একেবারেই আলাদা স্বাদের ও রূপের।

এক জনপ্রিয় কিংবদন্তি অনুযায়ী, বাকর খাঁন নামে একজন আফগান সেনাপতি ছিলেন, যিনি মোগল শাসকদের অধীনে কাজ করতেন। তিনি ঢাকায় আসার পর স্থানীয় রন্ধনশিল্পীদের দিয়ে এক বিশেষ ধরণের রুটি বানাতে বলেছিলেন, যা মিষ্টি হবে, কিন্তু শক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী হবে। সেই রুটির নাম হয় “বাকরখানি”—যা “বাকর খাঁনের খানি” অর্থে ব্যবহৃত।

আরেকটি মত হলো, বাকরখানি শব্দটি এসেছে ফারসি “বাকের” (ভাজা) এবং “খানি” (খাবার) থেকে, যার অর্থ “ভাজা রুটি”।

Bakarkhani Old Dhaka
Bakarkhani Old Dhaka

পুরান ঢাকার সাথে সম্পর্ক

পুরান ঢাকা শুধু লাচ্ছি, কাবাব বা বিরিয়ানির জন্য বিখ্যাত নয়—এখানকার বাকরখানি যেন একধরনের ঐতিহ্যবাহী প্রতীক। চকবাজার, ইসলামপুর, লালবাগ, আজিমপুরের আশেপাশের পুরনো বেকারিগুলোতে আজও ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গরম গরম বাকরখানি বানানো হয়।

রোজার ঈদ বা কোরবানির ঈদের আগে, এবং বিশেষ কোনো উৎসবে, পুরান ঢাকার বেকারিগুলোতে বাকরখানির চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। অনেকে গ্রামে বা বিদেশে আত্মীয়দের কাছে পাঠানোর জন্য বাকরখানি কিনে নিয়ে যান।

বাকরখানির বৈশিষ্ট্য

বাকরখানিকে সাধারণ রুটি বা বিস্কুটের সঙ্গে মিলিয়ে ফেললে ভুল হবে। এর কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে—

  1. দীর্ঘস্থায়ী – শুকনো ও শক্ত হওয়ায় অনেকদিন ভালো থাকে, বিশেষ করে বায়ুরোধী ডিব্বায়।
  2. খাস্তা টেক্সচার – বাহিরটা খাস্তা ও ভেতরটা খানিকটা চিবোনো যায় এমন।
  3. সুগন্ধি মিষ্টি স্বাদ – ঘি, এলাচ ও কখনও গোলাপজল ব্যবহারে বিশেষ সুগন্ধ।
  4. শিল্পসম্মত নকশা – উপরের অংশে হাত বা ছাঁচ দিয়ে করা অলংকরণ, যা ঢাকার ঐতিহ্যের পরিচয় বহন করে।

উপকরণ ও প্রস্তুত প্রণালী

বাকরখানি বানানো যত সহজ মনে হয়, আসলে ততটা সহজ নয়। এর আসল স্বাদ ও টেক্সচার পেতে হলে ধৈর্য ও সঠিক পদ্ধতি জানা জরুরি। সাধারণত যা যা লাগে—

উপকরণ

  • ময়দা – ৫০০ গ্রাম
  • ঘি – ১৫০ গ্রাম
  • চিনি – ১৫০ গ্রাম (গুঁড়া)
  • দুধ – ২০০ মি.লি.
  • এলাচ গুঁড়া – ১ চা চামচ
  • লবণ – এক চিমটি
  • গোলাপজল – ১ চা চামচ
  • তিল – ২ টেবিল চামচ (ঐচ্ছিক)

প্রস্তুত প্রণালী

  1. ডো তৈরি – ময়দা, লবণ, এলাচ গুঁড়া, ঘি মিশিয়ে মসৃণ ডো তৈরি করুন। দুধ দিয়ে ধীরে ধীরে নরম কিন্তু শক্তিশালী ডো তৈরি করতে হবে।
  2. বিরতি দেওয়া – ডো ঢেকে অন্তত ৩০ মিনিট বিশ্রামে রাখুন।
  3. বেলানো – গোল আকারে বেলে নিন এবং উপরের দিকে নকশা করুন।
  4. সিরাপ তৈরি – চিনি ও সামান্য পানি গরম করে হালকা সিরাপ তৈরি করুন।
  5. ওভেন বা তন্দুরে বেক – মাঝারি তাপে ১৫-২০ মিনিট বেক করুন। বাইরে সোনালি বাদামি হলে বের করে নিন।
  6. সিরাপ মাখানো – গরম অবস্থায় হালকা সিরাপ ব্রাশ করে দিন, তারপর ঠান্ডা করে পরিবেশন করুন।

বিভিন্ন ধরণ

ঢাকায় পাওয়া বাকরখানি কয়েকটি ধরনে বিভক্ত—

  1. মিষ্টি বাকরখানি – চিনি বা সিরাপ দেওয়া।
  2. লবণাক্ত বাকরখানি – চিনি কম, লবণ বেশি।
  3. ঘি-সমৃদ্ধ বাকরখানি – বেশি ঘি ও দুধ ব্যবহার করে নরম টেক্সচারের।
  4. তিল দেওয়া বাকরখানি – উপরে তিল ছিটানো থাকে।

সাংস্কৃতিক ও সামাজিক গুরুত্ব

বাকরখানি শুধু খাওয়ার জন্য নয়, বরং আতিথেয়তার অংশ। পুরান ঢাকার ঘরে অতিথি এলে অনেক সময় প্রথমেই বাকরখানি ও চায়ের আয়োজন করা হয়। গ্রামের মানুষের কাছে ঢাকার উপহার হিসেবে বাকরখানি নেওয়া এখনো প্রচলিত।

এটি ঐতিহ্যের বাহক হিসেবেও দেখা হয়। বিশেষ করে যারা বিদেশে থাকেন, তাদের কাছে বাকরখানি যেন ঢাকার গন্ধ ও স্বাদের স্মৃতি ফিরিয়ে আনে।

বর্তমান প্রেক্ষাপট ও পরিবর্তন

আগে বাকরখানি শুধুই পুরান ঢাকায় পাওয়া যেত, কিন্তু এখন রাজধানীসহ দেশের প্রায় প্রতিটি বড় শহরে এর দোকান আছে। আধুনিক বেকারিগুলোতে বাকরখানির ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণও পাওয়া যায়—কম চিনি, বেশি ঘি, এমনকি চকোলেট স্বাদও।

তবে অনেক পুরান ঢাকার বাসিন্দা মনে করেন, আধুনিক বেকারির বাকরখানি আসল স্বাদ হারাচ্ছে। কারণ তাতে তন্দুর বা ঐতিহ্যবাহী প্রস্তুত প্রণালীর পরিবর্তে মেশিন ব্যবহার করা হয়।

পুষ্টিগুণ

যদিও বাকরখানি বেশ ক্যালরিসমৃদ্ধ, এতে কিছু উপকারী দিকও আছে—

  • ঘি ও দুধ থেকে পাওয়া চর্বি ও প্রোটিন
  • ময়দা থেকে পাওয়া কার্বোহাইড্রেট
  • এলাচ থেকে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট
    তবে ডায়াবেটিস বা ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যক্তিদের পরিমিত খাওয়াই ভালো।

বাকরখানি – সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)

১. বাকরখানি কী?
বাকরখানি হলো এক ধরনের শক্ত, মিষ্টি ও সুগন্ধি রুটি, যা বাইরে খাস্তা এবং ভেতরে খানিকটা নরম হয়। সাধারণত চা বা দুধ চায়ের সাথে খাওয়া হয়।

২. বাকরখানির উৎপত্তি কোথায়?
বাকরখানির শিকড় মোগল আমলে, ধারণা করা হয় এটি কাশ্মীর থেকে লখনউ হয়ে ঢাকায় আসে। ঢাকায় এসে এটি বিশেষ স্বাদ ও রূপ পায়, যা পুরান ঢাকার ঐতিহ্যে পরিণত হয়।

৩. বাকরখানি নামের উৎস কী?
একটি জনপ্রিয় মত হলো আফগান সেনাপতি বাকর খাঁনের নাম থেকে “বাকরখানি” এসেছে। আরেক মতে, ফারসি শব্দ “বাকের” (ভাজা) ও “খানি” (খাবার) থেকে এর নাম হয়।

৪. কোথায় আসল ঢাকার বাকরখানি পাওয়া যায়?
চকবাজার, ইসলামপুর, লালবাগ, আজিমপুর ও পুরান ঢাকার পুরনো বেকারিগুলোতে আসল স্বাদের বাকরখানি পাওয়া যায়।

৫. বাকরখানি কতদিন ভালো থাকে?
বাকরখানি শুকনো ও শক্ত হওয়ায় ১০-১৫ দিন ভালো থাকে, যদি বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করা হয়।

৬. বাকরখানি বানাতে কোন উপকরণ লাগে?
প্রধান উপকরণ হলো ময়দা, ঘি, চিনি, দুধ, এলাচ গুঁড়া, লবণ এবং গোলাপজল।

৭. বাকরখানি কি স্বাস্থ্যকর?
এতে ময়দা, ঘি ও চিনি থাকায় ক্যালরি বেশি, তাই পরিমিত খাওয়াই ভালো। তবে এলাচ ও ঘি কিছু উপকারও করে।

৮. বাকরখানির দাম কত?
দাম দোকান ও মানের ওপর নির্ভর করে। সাধারণত প্রতিটি ২০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।

৯. বাকরখানির কত প্রকার আছে?
প্রধানত মিষ্টি বাকরখানি, লবণাক্ত বাকরখানি, ঘি-সমৃদ্ধ বাকরখানি এবং তিল দেওয়া বাকরখানি পাওয়া যায়।

১০. বাকরখানি কি দেশের বাইরে পাওয়া যায়?
বাংলাদেশি কমিউনিটি যেখানে আছে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ বা আমেরিকার কিছু শহরে, সেখানে বিশেষ দোকানে বা অনলাইনে বাকরখানি পাওয়া যায়।

উপসংহার

বাকরখানি শুধু এক টুকরো রুটি নয়—এটি ঢাকার সংস্কৃতি, ইতিহাস ও আতিথেয়তার প্রতীক। পুরান ঢাকার অলিগলিতে চায়ের ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে থাকা বাকরখানির গন্ধ যেন আমাদের শিকড়ের সাথে যুক্ত করে রাখে।

আজকের ফাস্টফুডের যুগেও যারা ঐতিহ্যের স্বাদ খুঁজে বেড়ান, তাদের জন্য বাকরখানি এক অনন্য আনন্দ।

TEK NEWS Desk

Leave a Comment