কক্সবাজার: সমুদ্র, সৌন্দর্য ও সম্ভাবনার জেলা

tek news icon bd

TEK NEWS DESK

April 2, 2022

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত কক্সবাজার জেলা শুধু দেশের নয়, বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সমুদ্রসৈকতের জন্য বিখ্যাত। প্রায় ১২০ কিলোমিটার বিস্তৃত এই সমুদ্রসৈকত দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে এক অনন্য গন্তব্য। তবে কক্সবাজারের পরিচয় শুধু সৈকতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—এটি সমৃদ্ধ ইতিহাস, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনার এক বিস্তৃত ভাণ্ডার।

ঐতিহাসিকভাবে, এই অঞ্চলের নামকরণ হয়েছে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের নামানুসারে, যিনি ব্রিটিশ শাসনামলে আরাকান শরণার্থীদের পুনর্বাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। আজকের কক্সবাজার বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের হৃদয়স্থল, যেখানে সমুদ্রসৈকত, দ্বীপ, পাহাড়, জলপ্রপাত এবং আদিবাসী সংস্কৃতির মিলনে গড়ে উঠেছে এক মনোমুগ্ধকর ভূ-প্রকৃতি।

ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে কক্সবাজার শুধু পর্যটনের জন্য নয়, বরং বাণিজ্য, মৎস্যশিল্প, লবণ উৎপাদন, এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে অসীম সম্ভাবনা বহন করছে। এখানকার নৈসর্গিক সৌন্দর্য যেমন পর্যটকদের আকর্ষণ করে, তেমনি এর প্রাকৃতিক সম্পদ দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে।

পরবর্তী অংশে আমরা কক্সবাজার জেলার ভৌগোলিক পরিচিতি, ইতিহাস, অর্থনীতি, পর্যটনকেন্দ্র, সংস্কৃতি ও সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

কক্সবাজার জেলা (Cox’s Bazar District)

ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রশাসনিক বিভাগ

  • অবস্থান: বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে কক্সবাজার জেলা চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত, আনুমানিক ২০°৪৩′ থেকে ২১°৫৬′ উত্তরে এবং ৯১°৫০′ থেকে ৯২°২৩′ পূর্ব দ্রাঘিমায় অবস্থিত।
  • প্রশাসনিক কাঠামো: জেলা অন্তর্ভুক্ত ৮টি উপজেলা (Cox’s Bazar Sadar, Moheshkhali, Chakoria, Kutubdia, Ramu, Ukhia, Teknaf, Pekua) ● ৪টি পৌরসভা ● ৭১টি ইউনিয়ন ● ১১৭৭ মৌজা ● ৯৮৯টি গ্রাম।
  • আয়তন: প্রায় ২,৪৯১.৮৫ বর্গকিমি।

ইতিহাস ও নামের উৎপত্তি

  • জেলা আধুনিক নামকরণ Captain Hiram Cox-এর নামে, যিনি ১৭৯৯ সালে মিয়ানমার থেকে আসা আরাকানি শরণার্থীদের পুনর্বাসনে নিয়োজিত ছিলেন। উৎসে একটি পটকা বাজার প্রতিষ্ঠা করা হয়, যা তাঁর নামে পরিচিতি লাভ করে।
  • এর পুরনো নাম ছিল Panowa, যার অর্থ “হলুদ ফুল” (yellow flower)।
  • সন ১৯৮৪ সালে এটি জেলা হিসেবে উপজাত করা হয়।

ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য

  • দীর্ঘতম অসমতল সমুদ্র সৈকত বিশ্বের মধ্যে অন্যতম — প্রায় ১৫৫ কিমি অবিচ্ছিন্ন বালুকাবেষ্টিত সৈকত।
  • প্রধান নদীগুলো: নাফ, মাতামুহুরী, বকখালী, কুতুবদিয়া ও মহেশখালী চ্যানেল।d
  • প্রধান বনাঞ্চল: Phulchhari, Bhumaria-ghona, Meher-ghona, Bakkhali রেঞ্জ।
  • Himchari National Park: ১,৭২৯ হেক্টরের একটি জাতীয় উদ্যান, অবস্থিত পাহাড় এবং উপকূলে, স্থাপিত ১৯৮০ সালে; যেখানে বিভিন্ন কাঠ ও বন্যপ্রাণী দেখা যায়।
  • Baishari Bangdepa Wildlife Sanctuary: ২০২৩ সালে প্রতিষ্ঠিত, ২,২৩৩ হেক্টরের এলাকা, যা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ।

অর্থনীতি ও পর্যটন

  • পর্যটন হলো মূল আয়ের উৎস। সিল, মাছ ধরার শিল্প, শেঁকা মাছ এবং হস্তশিল্প অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
  • বিশ্ব দীর্ঘতম সমুদ্র উপকূল সড়কCox’s Bazar–Teknaf Marine Drive, ৮০ কিমি দীর্ঘ, ২০১৭ সালে উদ্বোধিত।
  • Sabrang Tourism Park: বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, যা পর্যটন বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প।
  • Dulahazara Safari Park: ২,২২৪ একর বনজমিতে ঘেরা একটি সাফারি পার্ক, যেখানে প্রায় ৪,০০০ জন্তু রয়েছে।

জনসংখ্যা ও শিক্ষা

  • জনসংখ্যা (২০২৪): আনুমানিক ২.৯ মিলিয়ন; ঘনত্ব প্রায় ১,১৬৬ জন/বর্গকিমি।
  • শিক্ষা ও সাক্ষরতা: সাক্ষরতার হার প্রায় ৭১.৬%; স্কুলে উপস্থিতির হার (৫–২৪ বছর): ৭৬.৪৯%।

চ্যালেঞ্জ ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

  • রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট: কক্সবাজার জেলা রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা মোকাবিলার প্রবল কেন্দ্র, যা সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গুরুত্ব পেয়েছে।

সারাংশে, কক্সবাজার জেলা বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকূলীয় জেলা, যা তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব, স্বকীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য এবং আধুনিক উন্নয়নের কারণে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।

কক্সবাজার: সমুদ্রের কাছে দিন গোনে স্বপ্ন

১. জ্যোতির্দশা ও ভৌগোলিক পরিস্থিতি

কক্সবাজার জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে, চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত একটি উপকূলীয় জেলা। এর ভৌগোলিক কোঅর্ডিনেট লক্ষ করলে দেখা যায়—২০°৪৩′ থেকে ২১°৫৬′ উত্তর অক্ষাংশ ও ৯১°৫০′ থেকে ৯২°২৩′ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থান করে এটি। এলাকা প্রায় ২৪৯২ বর্গ কিলোমিটার (বা অন্য সূত্রে ২৩৮২.৩৮ বর্গ কিমি)। উত্তরে চট্টগ্রাম, পূর্বে বান্দরবান ও মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য, দক্ষিণ ও পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর—পরিবেষ্টিত এই অঞ্চলের ভৌগোলিক বৈচিত্র্য অপরিসীম।

২. ইতিহাস ও নামকরণ

প্রাচীন যুগে ‘পানোয়া’ বা ‘পালংকি’ নামে পরিচিত কক্সবাজার। এর অর্থ ছিল—হলুদ ফুল। আর নামের আধুনিক উৎস Captain Hiram Cox—যিনি ১৭৯৯ সালে আরাকানি শরণার্থীদের পুনর্বাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তাঁর স্মৃতিতে ওই স্থানে ‘বাজার’ উত্থাপন করে নাম দেওয়া হয় কক্সবাজার। ব্রিটিশ শাসনামলে প্রতিষ্ঠান, ১৯৮৪ সালে জেলা হিসেবে আলাদা করা হয় এই অঞ্চলকে।

৩. প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য

কক্সবাজার বাংলাদেশের—and arguably বিশ্বের—সবচেয়ে বড় অবিচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক বালুময় সমুদ্র সৈকত। দৈর্ঘ্য প্রায় ১২০ থেকে ১৫০ কিমি। এই সৈকতের উপরে সমুদ্রের ঢেউ আর আলোর খেলা কত জাদুকরী—সে বর্ণনা কাগজে বিহীন। পাশাপাশি পুরু পাহাড়, বালি, বন, চর আর নদী—সকল একসাথে মিশে সৃষ্টি করেছে এক অনন্য প্রাকৃতিক দৃশ্যপট।

৪. পর্যটন ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব

পর্যটন অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি। এখানে প্রতিদিন হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটক আসে—এটা শুধু পর্যটন পর্যটন নয়; এটি অর্থনৈতিক, সামাজিক, সংস্কৃতিক বিপ্লব।

কক্সবাজারের অন্যতম আকর্ষণ—মহেশখালী, কুতুবদিয়া দ্বীপ, সোনাদিয়া, শাহ পরীর দ্বীপ এবং সেন্ট মার্টিনস (জিনজিরা)। ট্রেন—ঢাকা-চট্টগ্রাম-মহেশখালী রুটে চালু হয়েছে “কক্সবাজার এক্সপ্রেস” ও “পর্যটক এক্সপ্রেস”। ১১ নভেম্বর ২০২৩ নতুন রেললাইন উদ্বোধন, ১ ডিসেম্বর ২০২৩ থেকে বাণিজ্যিক ট্রেন চালু।

পর্যটন ছাড়াও, স্থানীয় মৎস্য বন্দর, সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশন—স্মার্ট বুনিয়াদি কাঠামোর উদাহরণ।

৫. প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য

হিমছড়ি জাতীয় উদ্যান, ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক, টেকনাফ বনাঞ্চল, বৌদ্ধ বিহার, ছেঁড়া দ্বীপ— এসব জীববৈচিত্র্যের ভান্ডার।এখানে প্রাণীমূলক অঞ্চল, বৃক্ষ, জন্তুদের আশ্রয়স্থান।

৬. জনসংখ্যা ও সামাজিক পরিসংখ্যান

জনসংখ্যা আনুমানিক ১৭৭৩৭০৯—মোট জনসংখ্যায় মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য ধর্মের মানুষ মিলেমিশে বাস করেন। ভাষাগতভাবে চাটগাঁইয়া কথ্য।

৭. সমসাময়িক সমস্যাসমূহ

রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট

কক্সবাজার জেলা বিশ্বে সবচেয়ে বড় রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোর কেন্দ্র। এক মিলিয়নের অধিক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন এখানে। স্বাস্থ্য, খাদ্য, নিরাপত্তা—সব ক্ষেত্রেই চ্যালেঞ্জ। ইস্যুতে জাতিসংঘ মহাসচিব ‘অপরাধ’ বলে অভিহিত করেছেন আন্তর্জাতিক সহায়তা কম থাকাকে। গর্ভবতী মায়েদের মৃত্যুহার এবং চরম পরিস্থিতিতে টীকাদানও চরম উদ্বেগের বিষয়।

স্বাস্থ্যসেবা ও রোগ

চিকিৎসা সুযোগ–সুবিধার অভাবে দীর্ঘস্থায়ী রোগ—যেমন ক্যান্সার, ডায়াবেটিস—বাড়ছে শিবিরে। এ নিয়ে সময়ের দাবি অনেকেই এ সংক্রান্ত সরকারি বা আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ চান।

নারী ও শিশুদের ওপর সামাজিক চাপ

কক্সবাজারে কিছু মেয়েরা কাজের পরেও স্কুলে যায়; তাদের মধ্যে surfing ক্লাব, ইংরেজি শেখার সুযোগ মেলে—বিয়ে ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তির আশা এনে।

৮. সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও পরিদর্শনীয় স্থান

কক্সবাজারের শহরে রয়েছে বিভিন্ন ভাস্কর্য: সাম্পান, স্টার ফিশ, রূপচাঁদা, ঝিনুক। পুরনো পুকুর—লালদিঘী, গোলদিঘী, বাজারঘাটা—ঐতিহাসিক স্মৃতি বহন করে। পাঁচস্তার হোটেল থেকে দোকান, মোবাইল ভ্রমণ তথ্য কেন্দ্র—সামগ্রিকভাবে পর্যটনকে অনান্দদায়ক করে তুলেছে।

সমাপনী কথন

কক্সবাজার একটি সীমান্তবর্তী জেলা যেখানে প্রকৃতি, ইতিহাস, সামাজিক বৈচিত্র্য, পর্যটন ও সমসাময়িক সমস্যা একসাথে মিশে রয়েছে। সমুদ্র সৈকতের কিরণ, বন-বিলের ডাক, পার্বত্য ছোঁয়া, আর শরনার্থী শিবিরের মানবিক অভিঘাত—সবই এই জেলার এক অভিজ্ঞতা। এখানে যেভাবে সৃষ্টিশীলতা এবং মানবতা পরস্পরতাকে স্পর্শ করে—এটাই কক্সবাজারের স্বতন্ত্র সৌন্দর্য।

TEK NEWS DESK

Leave a Comment